জুন ২১, ১৯৭৫। লর্ডসে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে। বল হাতে ছুটে আসছেন ভ্যানবার্ন হোল্ডার। ব্যাটিং-এ ডেনিস লিলি ও জেফ থম্পসন। স্ট্রাইক রোটেট করতে গিয়ে ক্যারিবিয়ান কিপার ডেরিক মারের থ্রোতে রান আউট হয়ে গেলেন থম্পসন। অজিদের আশার বেলুনও ফুটো হয়ে উড়ে গেল আকাশে। ক্রিকেটের প্রথম বিশ্বকাপ নিজেদের করে নিলেন ক্লাইভ লয়েড-ভিভ রিচার্ডসদের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে সেই সময় এর নাম বিশ্বকাপ ছিল না। ছিল প্রুডেনশিয়াল কাপ। সেই প্রুডেনশিয়াল কাপ কি করে বিশ্বকাপ হলো এবং সেই বিশ্বকাপ কিভাবে ক্রিকেট নেশন্সগুলোর জন্য সবচেয়ে মর্যাদার ট্রফি হয়ে উঠলো তা নিয়েই ডিটেইলে আলোচনা করা যাক।
অরিজিন অফ ক্রিকেট
বিশ্বকাপের
ইতিহাসে যাওয়ার আগে চলেন একদম ক্রিকেটের শুরুর সময় থেকে ঘুরে আসা যাক। যতদূর জানা
যায়, ক্রিকেটের শুরুটা ষোড়শ শতাব্দীর শেষদিকে। ইংলিশরাই শুরু করে খেলাটি। বিংশ শতাব্দীতে
পুরো বিশ্বে খেলাটি ফেমাস হয়ে উঠার আগে ইংল্যান্ডের জাতীয় খেলায় পরিণত হয়েছিল এটি।
১৮৩৬ সালের ৩রা আগস্ট,
হ্যাম্পটন কোর্ট গ্রিনে রয়্যাল অ্যামেচার সোসাইটির সদস্যদের মধ্যে খেলা ম্যাচটিকে
ক্রিকেটের প্রথম গ্র্যান্ড ম্যাচ হিসেবে ধরা হয়। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট খেলা শুরু
হয় মূলত ১৮৪৪ সালে। তবে টেস্ট ক্রিকেটের শুরুটা আরেকটু পরে। ১৮৭৭ সালে। মুখোমুখি হয়েছিল
দুই আর্চ রাইভাল অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড। আরেকটি মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্বকাপ শুরুরও
অনেক আগে ক্রিকেট খেলাকে অলিম্পিকে অ্যাড করা হয়েছিল। সেটা ১৯০০ সালের কথা। যদিও পরে
অলিম্পিক কমিটি ক্রিকেটকে বাদ দিয়ে দেয়।
পুরো লেখাটি পড়তে না চাইলে ভিডিওটি দেখুন
ওয়ানডে ক্রিকেট - ক্রিকেটের আনএক্সপেক্টেড চাইল্ড?
৫ জানুয়ারি, ১৯৭১। মেলবোর্নে হওয়ার কথা ছিল ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার
মধ্যকার টেস্ট ম্যাচের পঞ্চম দিনের খেলা। কিন্তু আগের চারদিনের খেলাই বৃষ্টির কারণে
আর মাঠে গড়ায়নি। দর্শকরা সেই সময়ে চুড়ান্ত পরিমাণে ক্ষ্যাপা। উত্তেজিত দর্শকদের সামলাতে
কর্তৃপক্ষ ঠিক করে খেলা হবে চল্লিশ ওভারে। সেই সময়ে প্রতি ওভার হতো ৮ বলে। এভাবেই আনএক্সপেক্টেডলি
মাঠে গড়ায় প্রথম ওয়ানডে ক্রিকেট ম্যাচ। পরে যেই ফরম্যাট ধীরে ধীরে ক্রিকেটের সবথেকে
পপুলার ফরম্যাটে পরিণত হয়।
বিশ্বকাপ ক্রিকেট এলো
কোথা থেকে?
১৯৭৫ সালের কথা। আইসিসির মনে
হচ্ছিলো টেস্ট প্লেয়িং নেশনরা পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না। তাই তারা ঠিক করে
ওয়ানডে ফরম্যাটে সবগুলো দেশকে নিয়ে একটি ট্যুর্নামেন্ট আয়োজন করার। প্রুডেনশিয়াল
প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি স্পন্সর হিসেবে থাকার কারণে ট্যুর্নামেন্টের নাম দেওয়া
হয় ‘প্রুডেনশিয়াল কাপ’। প্রতি ইনিংসের লিমিট নির্ধারণ করা হয় ৬০ ওভার করে। প্রথম
ট্যুর্নামেন্টে ছয়টি টেস্ট প্লেয়ং নেশন ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ,
পাকিস্তান, ইন্ডিয়া ও নিউজিল্যান্ডের পাশাপাশি সুযোগ দেওয়া হয় সহযোগী দেশ
শ্রীলঙ্কা ও ইস্ট আফ্রিকাকে। সেই সময়ে পলিটিকাল কারণে স্পোর্টস ওয়ার্ল্ডে সাউথ
আফ্রিকার উপরে নিষেধাজ্ঞা থাকায় তারা পার্টিসিপেট করতে পারে নি। যাই হোক, শুরুতে
যেমন বললাম, ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ক্রিকেট সিংহাসনের প্রথম রাজা হিসেবে
আবির্ভুত হয় ক্যারিবিয়ানরা।
পরের দুটো ট্যুর্নামেন্টেরও নাম
ছিল প্রুডেনশিয়াল কাপ। খেলাও হয়েছিল ইংল্যান্ডেই। বিশ্বকাপে আইসিসির ফুল
মেম্বারদের পাশাপাশি সহযোগী দেশগুলোকেও সুযোগ করে দেওয়ার জন্যে ১৯৭৯ সালে
প্রথমবারের মতো শুরু হয় আইসিসি ট্রফি। সেখানে অংশ নেয় মোট ১৫ টি দেশ। যার মধ্যে
বাংলাদেশও ছিল। তবে অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার হচ্ছে সেখানে বাংলাদেশের থেকেও ভালো
পজিশনে থেকে ট্যুর্নামেন্ট শেষ করে বারমুডা, ইস্ট আফ্রিকা, ডেনমার্ক, কানাডা,
ইউনাইটেড স্টেটস ও ওয়েলসের মতো দল! ফাইনালে মুখোমুখি হয় শ্রীলঙ্কা ও কানাডা।
সেখানে জিতে বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করে লঙ্কানরা। সেই আসরে টানা দ্বিতীয়বারের মতো
জিতে নিজেদের সিংহাসন ধরে রাখে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তবে পরের প্রুডেনশিয়াল কাপ আসরে
তাদেরকে হারিয়ে ময়দানে নতুন রাজা হিসেবে আবির্ভুত হয় কাপিল দেভের ভারত।
ট্যুর্নামেন্ট শুরুর আগে যাদের জয়ের পক্ষে অড ছিল ৬৬!
প্রুডেনশিয়াল কাপ থেকে
বিশ্বকাপ হয়ে ওঠা
১৯৮৭ সালে ট্যুর্নামেন্টের
স্পন্সর হয়ে আসে রিলায়েন্স। ইংল্যান্ডের বাইরে প্রথমবারের মতো ভারত ও পাকিস্তানে
আয়োজন করা হয় সেই আসর। প্রুডেনশিয়াল কাপ থেকে নাম হয়ে যায় রিলায়েন্স কাপ। প্রতি
ইনিংসও ৬০ ওভার থেকে কমিয়ে ৫০ ওভার করা হয়। সেবার ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে
শিরোপা জেতে অস্ট্রেলিয়া।
১৯৯২ সালে তাই বিশ্বকাপ চলে যায়
অস্ট্রেলিয়ায়। স্পন্সরজনিত কারণে এর নাম হয়ে যায় বেনসন অ্যান্ড হেজেস ওয়ার্ল্ড
কাপ। প্রথমবারের মতো রঙিন পোষাক ও সাদা বলে খেলা হয় সেবার। ডে-নাইট ম্যাচ ও
ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশনও সেই আসর থেকেই প্রথম শুরু হয়। স্পোর্টস থেকে নিষেধাজ্ঞা
কাটিয়ে সাউথ আফ্রিকাও ফিরে আসে সেই আসরে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ফাইনালে
ইংল্যান্ডকে হারিয়ে সেই আসরটি জিতে নেয় ইমরান খানের পাকিস্তান।
১৯৯৬ সালে বিশ্বকাপ আবারও ফিরে
আসে সাউথ এশিয়ায়। ইন্ডিয়া, পাকিস্তানের সাথে সেই বার আয়োজকের খাতায় নাম লেখায়
শ্রীলঙ্কা। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার মতো শক্তিশালী দলকে হারিয়ে কাপও জিতে নেয় তারা।
ট্যুর্নামেন্ট জুড়ে দুর্দান্ত পারফর্ম করেন আরাভিন্দ ডি সিলভা ও সানাথ জয়াসুরিয়া।
এরপরের বিশ্বকাপটি কয়েকটি কারণে
খুবই ইম্পর্ট্যান্ট। প্রথমবারের মতো স্পন্সরদের নামে বিশ্বকাপ আসরের নাম দেওয়া
বন্ধ করা হয় সেবারেই। এরপর থেকেই বিশ্বকাপের নামকরণ করা হয় ‘আইসিসি ক্রিকেট
ওয়ার্ল্ড কাপ’। এছাড়াও ১৯৯৯ তেই প্রথমবারের মতো আইসিসি ট্রফি জিতে বিশ্বকাপ খেলার
যোগ্যতা অর্জন করে বাংলাদেশ। সেই আসরটি জিতে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ ঘরে তোলে
অস্ট্রেলিয়া। পরের দুটো বিশ্বকাপও টানা তারাই জেতে। সেই সময়ের অস্ট্রেলিয়া ছিল
ক্রিকেট ময়দানের সিংহ। পন্টিং, গিলক্রিস্ট ও ম্যাকগ্রাদের সেই দল ছিল ভয়ংকর। ঘরের
মাঠে ২০১৫ এর বিশ্বকাপ জিতে বিশ্বকাপে ৫ বার চ্যাম্পিয়ন হয়ে নিজেদের ধরা-ছোয়ার
বাইরে নিয়ে যায় টিম অস্ট্রেলিয়া। এছাড়া ২০১১ ও ২০১৯ এর বাকি দুই আসরে ট্রফি উচিয়ে
ধরে ভারত ও ইংল্যান্ড।